ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

টেকনাফ পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্যের তদন্ত

teknaf_2কক্সবাজার প্রতিনিধি :::

ইয়াবা কারবারির অভিযোগ তুলে টেকনাফ থানা পুলিশের গণহারে গ্রেপ্তার বাণিজ্য নিয়ে নির্যাতিত লোকজন অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়েছেন পুলিশের তদন্তকারি কর্মকর্তার কাছে। রাতের বেলায় পুলিশ ঘরে ঘরে হানা দিয়ে ধরে নিয়ে চোখ বেঁধে নির্মম নির্যাতন করে লোকজনেক।

ইয়াবা দিয়ে চালান দেওয়ার ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক আদায় করে লাখ লাখ টাকা। নগদ টাকা না থাকলে মা-বোনের ব্যবহৃত স্বর্ণালংকার বিক্রি করতেও বাধ্য করে। মা এবং বোনের স্বর্ণালংকার বিক্রি করে পুলিশকে নগদ সাড়ে ৪ লাখ টাকা দিয়ে মুক্তি পাওয়া এনজিওকর্মী ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে অঝোরে কেঁদে ফেলেন।

আজ (বুধবার) কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুলের কাছে এরকম স্বাক্ষ্য দিয়েছেন টেকনাফ থানা পুলিশের হাতে নির্যাতিত এবং গ্রেপ্তার বাণিজ্যের শিকার ৬ ব্যক্তি। গ্রেপ্তার বাণিজ্যের মাধ্যমে পুলিশ এই ৬ জনের নিকট থেকে আদায় করে নিয়েছেন ১২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। তাও গ্রেপ্তার বাণিজ্যের শিকার হওয়া এসবের মধ্যে ৪ জনই হচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মী।

টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে আন্তর্জাতিক অভিভাশন সংস্থা (আইওএম)-র মাঠকর্মী হিসাবে কর্মরত আবদুল্লাহ (২০) কে গত ৫ জুলাই বিকালে শিবির সংলগ্ন এলাকা থেকে পুলিশ আটক করে। আবদুল্লাহ টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের পানখালী গ্রামের বাসিন্দা।

আবদুল্লাহ আজ তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন, আমি হ্নীলা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের কার্যকরি কমিটির সদস্য। লেখাপড়ার ফাঁকে আইওএম-তে মাসিক সাড়ে ১৩ হাজার টাকা বেতনে চাকুরি করি। আমি জীবনেও ইয়াবা কারবার করিনি। অথচ পুলিশের এসআই রহিম আমাকে ধরে ইয়াবা কারবারি এবং তালিকাভূক্ত অভিযোগে।

আবদুল্লাহ জানান, পুলিশ তাকে ধরে চোখে কাপড় বেঁধে টেকনাফ থানার তিন তলার একটি রুমে আটকিয়ে রাখে। রাতে তাকে মাথায়, ঘাড়ে ও সারা শরীর জুড়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়। মারধরের পর তার নিকট বিপুল পরিমাণ ইয়াবা পাওয়া গেছে জানিয়ে এসআই রহিম ১০ লাখ টাকা দাবি করে।

আবদুল্লাহ আরও বলেন, আমার এনজিও’র চাকুরির টাকায় সংসার চলে। ঘরে নগদ টাকার নেই। এসআই রহিম হুংকার দিয়ে বলেন-টাকা না দিলে কয়েক হাজার ইয়াবা দিয়ে চালান করা হবে।

এমনকি মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের সময় বন্দিশালায় যে নির্মমতা চালানো হত সে রকম নির্যাতনের আর্তচীৎকার মোবাইলে শুনিয়ে মা-বোনকে টাকা যোগাড়ে বাধ্য করা হয়। শেষাবধি আবদুল্লাহর বোনের ৬ ভরি এবং তার মায়ের সাড়ে ৩ ভরিসহ মোট সাড়ে ৯ ভরি স্বর্ণালংকার বন্ধক ও বিক্রিসহ ধার হাওলাদ দিয়ে মুক্তি পান তিনি। মা-বোনের স্বর্ণালংকার বিক্রির কথা বলতে গিয়ে এই তরুণ অঝোরে কেঁদে ফেলেন।

টেকনাফের হ্নীলা মৌলভীবাজারে এনজিও সংস্থা ‘সূর্যের হাসি’তে চাকুরি করেন যুবক কামাল উদ্দিন ও তার স্ত্রী রোকসানা পারভীন। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের পানখালী গ্রামের বাসিন্দা কামালের ঘরে গত ২০ জুন রাতে হানা দেয় টেকনাফ থানার এসআই রহিমসহ তার দলটি। যুবক কামালকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে পুলিশ থানার একটি কক্ষে আটকিয়ে রাখে। ঘর থেকে থানায় নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত মাইক্রোবাসে রাস্তায় এসআই রহিম কামালকে বেদম মারধর করেছে।

ইয়াবা নিয়ে তাকে আদালতে চালান দেয়ার কথা বলে দাবি করা হয় নগদ ১০ লাখ টাকা। তাকে মারধর করে শেষ পর্যন্ত তিন লাখ টাকা আদায় করা হয়। থানা থেকে মুক্ত করে দেয়ার সময় এসআই রহিম কামালকে বলেন-খবরদার এসব কথা কাউকে যাতে না বলে। থানায় আটক করার কারণ হিসাবে কামালের স্ত্রী তার (কামাল) বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়ার কথা জানাতেও পরামর্শ দেন-এসআই রহিম।

কামাল তদন্ত কর্মকর্তাকে আরো জানান, তিন লাখ টাকা দিতে আমি আশা এনজিও থেকে কিস্তিতে ঋণ নিই এবং আমার স্ত্রী ও বোনের স্বর্ণালংকার বিক্রি করতে বাধ্য হই।

এমন ঘটনার অভিযোগ এনে কামাল তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আরো জানান, এসআই রহিম মঙ্গলবার ও আজ বুধবার সকালে কয়েক দফা কামালের ঘরে গিয়ে হুংকার দিয়েছেন যাতে তিনি জেলা পুলিশ সুপারের অফিসে এসে কোন সাক্ষ্য না দেন। এমনকি তার স্ত্রীকেও এর পরিণতি ভার হবেনা বলে জানিয়ে দেন।

পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্যের ব্যাপারে বিশদ বিবরণ দিয়ে সাক্ষ্য প্রদান করেন টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ফরিদ আহমদ রমজান। তিনি জানান, তাকে ধরে নিয়ে এক লাখ টাকা আদায় করেন এসআই একরামুজ্জামান।

টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা হাফেজ আহমদ জানান, এসআই মুফিজুল ইসলাম তাকে ইয়াবা কারবারি হিসাবে ধরে নিয়ে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। পরে দেড় লাখ টাকা নিযে তাকে ছেড়ে দেন। আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আলম অনুরুপ ৬০ হাজার টাকা এবং আবু তাহের ২ লাখ ২০ হাজার টাকা দিযে মুক্তি পান বলেও তদন্ত কর্মকর্তাকে জানান।

টেকনাফ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জানান, টেকনাফ থানা পুলিশ ইয়াবা কারবারি ও বিএনপিপন্থী লোকজনদের থানার সোর্স নিয়েগের মাধ্যমে সীমান্তে আওয়ামী লীগ নিধনের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল বলেন, অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমি তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। যে সব ব্যক্তি পুলিশী হয়রানির শিকার হয়েছেন তারা সবাই সাহসের সাথেই সাক্ষ্য দিয়েছেন। এমনকি আমি থানার অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদেরও ডেকে নিয়ে এসেছি।
তিনি জানান, তদন্ত পূর্বক দোষী কর্মকর্তাদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাঠকের মতামত: